ধর্ম যার: উৎসবও তার -মাহমুদুর রহমান দিলাওয়ার

সিলেট

 

লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন। অর্থ: তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আর আমার দ্বীন আমার। [১০৯. সূরা কাফিরুন: ৬]। আয়াতটি সুপরিচিত। মুসলিম সবারই জানা। এমনকি অমুসলিম ভাই-বোনেরাও কমবেশী জানেন। কেননা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গিয়ে অনেক মুসলিমরা আয়াতটি কিংবা এর সরল অনুবাদের আলোকে কিছু বক্তব্য শুনিয়ে আসেন। উদার মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই আয়াতটি অহরহ অপব্যাখ্যার মুখোমুখি হচ্ছে। বিষয়টি হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে। অন্তরে কষ্টের উদ্রেক হয়। দয়াকরে কেউ ভুল বুঝবেন না। ভুল বুঝলেও করার কিছু নেই। আয়াতটি সম্পর্কে মৌলিক ধ্যান-ধারণা পরিস্কার করার উদ্দেশ্যেই আজ অল্প লেখার চেষ্টা করছি। কুরআনুল কারীম এমন আ’যীম এক কিতাব, যার তাফসীর, ব্যাখ্যা কিংবা এর ব্যাপারে মন্তব্য করার মতো কোনো ইলম বা জ্ঞান আমার নেই। তবে মুফাসসিরগণ যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা সংক্ষিপ্তভাবে আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করেছি।

যদি তোমরা তোমাদের দ্বীন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো এবং তা ত্যাগ করতে রাজী না হও, তাহলে আমিও নিজের দ্বীন নিয়ে সন্তুষ্ট, তা কেন ত্যাগ করব? অর্থাৎ, আমাদের কর্ম আমাদের এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের জন্য। [২৮. আল-ক্বাসাস: ৫৫]। তাছাড়া তোমাদের কর্ম ভ্রষ্ট এবং আমার কর্ম শ্রেষ্ঠ। আর অন্যায়ের সাথে কোন আপোস নেই। [তাফসীরে আহসানুল বায়ান]।

এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইবনে কাসীর (র:) বলেন, এ বাক্যটি তেমনি যেমন অন্য আয়াতে আছে, “আর তারা যদি আপনার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তবে আপনি বলবেন, আমার কাজের দায়িত্ব আমার এবং তোমাদের কাজের দায়িত্ব তোমাদের।” [১২. সূরা ইউনুস: ৪১] অন্য আয়াতে এসেছে, “আমাদের কাজের ফল আমাদের জন্য এবং তোমাদের কাজের ফল তোমাদের জন্য”। [২৮. সূরা আল-কাসাস: ৫৫; ৪২. সূরা আশ-শূরা: ১৫]। এর সারমর্ম এই যে, ইবনে-কাসীর দ্বীন শব্দকে দ্বীনি ক্রিয়াকর্মের অর্থে নিয়েছেন। যার অর্থ, প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্মের প্রতিদান ও শাস্তি ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ আমার দ্বীন আলাদা এবং তোমাদের দ্বীন আলাদা। আমি তোমাদের মা’বুদের পূজা-উপাসনা কিংবা বন্দেগী করি না এবং তোমরাও আমার মাবুদের পূজা-উপাসনা কিংবা বন্দেগী করো না। আমি তোমাদের মা’বুদদের বন্দেগী করতে পারি না এবং তোমরা আমার মাবুদের বন্দেগী করতে প্ৰস্তুত নও। তাই আমার ও তোমাদের পথ কখনো এক হতে পারে না।

বর্তমান কালের কোনো কোনো জ্ঞানপাপী মনে করেন যে, এখানে কাফেরদেরকে তাদের দ্বীনের উপর থাকার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তারা এটাকে ইসলামের উদারনীতির প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকেন। নিঃসন্দেহে ইসলাম উদার। ইসলাম কাউকে অযথা হত্যা বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে অনুমতি দেয় না। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে কুফরী থেকে মুক্তি দিতে তাদের মধ্যে দাওয়াত ও দ্বীনের প্রচার প্রসার ঘটানো থেকে বিরত থাকতে বলেনি। ইসলাম চায় প্রত্যেকটি কাফের ও মুশরিক ইসলামের ছায়াতলে এসে শান্তির বার্তা গ্ৰহণ করুক। আর এ জন্য ইসলাম প্রজ্ঞা, উত্তম উপদেশবাণী, উত্তম পদ্ধতিতে তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর পথে আহবান করাকে প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য করণীয় বিষয় হিসেবে ঘোষণা করেছে। আল্লাহ তা’য়ালা আহবান জানান: আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন আপনার রবের পথে হিকমত ও সদুপদেশ সহকারে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করবেন উত্তম পন্থায়।নিশ্চয়ই আপনার রব, তাঁর পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়েছে, সে সম্বন্ধে তিনি বেশী জানেন এবং কারা সৎপথে আছে তাও তিনি ভালোভাবে জানেন। [১৬. সূরা আন-নাহল: ১২৫]। মূলত: এ সমস্ত জ্ঞানপাপীরা এ বিষয়টিকেই সহ্য করতে চায় না। অথচ এটা ঈমান আনার পরে কুফরী করার শামিল, যা মূলত কাফেরদের প্রতি উদারনীতি নয়। বরং তারা কাফের থাকা অবস্থায় চিরকালের জন্য তাদের ব্যাপারে দায়মুক্তি, সম্পর্কহীনতা ও অসন্তোষের ঘোষণাবাণী। আর এ সূরায় কাফেরদের দ্বীনের কোন প্রকার স্বীকৃতিও দেয়া হয়নি। মূলত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি যারা ঈমান এনেছে তারা দ্বীনের ব্যাপারে কখনো তাদের সাথে সমঝোতা করবে না- এ ব্যাপারে তাদেরকে সর্বশেষ ও চূড়ান্তভাবে নিরাশ করে দেয়া; আর তাদের সাথে সম্পর্কহীনতার ঘোষণাই এ সূরার উদ্দেশ্য। এ সূরার পরে নাযিল হওয়া কয়েকটি মক্কী সূরাতে কাফেরদের সাথে এ দায়মুক্তি, সম্পর্কহীনতা ও অসন্তোষ প্রকাশের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, “হে নবী! বলে দিন হে লোকেরা, যদি তোমরা আমার দ্বীনের ব্যাপারে (এখানে) কোন রকম সন্দেহের মধ্যে থাকো তাহলে (শুনে রাখো), আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদের বন্দেগী করছো। আমি তাদের বন্দেগী করি না। বরং আমি শুধুমাত্র সেই আল্লাহর বন্দেগী করি যার কর্তৃত্বাধীনে রয়েছে তোমাদের মৃত্যু।” [১২. সূরা ইউনুস: ১০৪] অন্য সূরায় আল্লাহ আরও বলেন, “হে নবী! যদি এরা এখন আপনার কথা না মানে তাহলে বলে দিন, তোমরা যা কিছু করছে তা থেকে আমি দায়মুক্ত”। [৪২. সূরা আশ-শূরা: ২১৬]।

অন্যত্র বলা হয়েছে, “এদেরকে বলুন, আমাদের ত্রুটির জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না এবং তোমরা যা কিছু করে যাচ্ছে সে জন্য আমাদের জবাবদিহি করতে হবে না। বলুন, আমাদের রব একই সময় আমাদের ও তোমাদের একত্র করবেন এবং আমাদের মধ্যে ঠিকমতো ফায়সালা করবেন।” [৩৪. সূরা সাবা: ২৫–২৬]। অন্য সূরায় এসেছে, “এদেরকে বলুন হে আমার জাতির লোকেরা তোমরা নিজেদের জায়গায় কাজ করে যাও। আমি আমার কাজ করে যেতে থাকবো। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে কার ওপর আসছে লাঞ্ছনাকর আযাব এবং আর আপতিত হবে তার উপর স্থায়ী শাস্তি।” [৩৯. সূরা আয-যুমার: ৩৯–৪০]। আবার মদীনা তাইয়েবার সমস্ত মুসলিমকেও এই একই শিক্ষা দেয়া হয়। তাদেরকে বলা হয়েছে, “তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথীদের মধ্যে রয়েছে একটি উত্তম আদর্শ। (সেটি হচ্ছে) তারা নিজেদের জাতিকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে, আমরা তোমাদের থেকে ও তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব মাবুদদের পূজা করো তাদের থেকে পুরোপুরি সম্পর্কহীন। আমরা তোমাদের কুফরী করি ও অস্বীকৃতি জানাই এবং যতক্ষণ তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনো ততক্ষণ আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরকালীন শক্ৰতা সৃষ্টি হয়ে গেছে।” [৬০. সূরা আল-মুমতাহিনাহ: ৪]।

কুরআনুল কারীমে একের পর এক এসব সুস্পষ্ট বক্তব্যের পর তোমরা তোমাদের ধর্ম মেনে চলো এবং আমাকে আমার ধর্ম মেনে চলতে দাও- “লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন” এর এ ধরনের কোন অর্থের অবকাশই থাকে না। বরং সূরা আয-যুমার এ যে কথা বলা হয়েছে, একে ঠিক সেই পর্যায়ে রাখা যায় যেখানে বলা হয়েছেঃ “হে নবী! এদেরকে বলে দিন, আমি তো আমার দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে তাঁরই ইবাদাত করবো। তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে যার ইচ্ছে তার বন্দেগী করতে চাও করতে থাকো।” [৩৯:১৪]। সুতরাং এটাই এ আয়াতের মূল ভাষ্য যে, এখানে কাফেরদের সাথে সম্পর্কচ্যুতি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এটাও লক্ষণীয় যে, পবিত্র কুরআনে একথাও আছে, “কাফেররা সন্ধি করতে চাইলে তোমরাও সন্ধি করো।” [৮. সূরা আল আনফাল: ৬১] তাছাড়া মদীনায় হিজরত করার পর রাসূলুল্লাহ (সা:) তাঁর ও ইয়াহুদীদের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। তাই সম্পর্কচ্যুতির অর্থ এ নয় যে, তাদের সাথে প্রয়োজনে সন্ধিচুক্তি করা যাবে না। মূলত সন্ধির বৈধতা ও অবৈধতার আসল কারণ হচ্ছে স্থান-কাল-পাত্র এবং সন্ধির শর্তাবলি। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ফয়সালা দিতে গিয়ে বলেছেন- “সে সন্ধি অবৈধ, যা কোন হারামকে হালাল কিংবা হালালকে হারাম করে।” [আবু দাউদ: ৩৫৯৪, তিরমিযী: ১৩৫২, ইবনে মাজাহ: ২৫৫৩]।

সূরা আল-কাফিরুন নাযিলের ঐতিহাসিক পটভূমি জানার চেষ্টা করলে, বিষয়টি বুঝা আরও সহজ হবে; ইন শা আল্লাহ। তাফহীমুল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে: মক্কায় এমন এক যুগ ছিলো যখন নবী (সা:)-এর ইসলামী দাওয়াতের বিরুদ্ধে কোরাইশদের মুশরিক সমাজে প্রচন্ড বিরোধিতা শুরু হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা:)-কে কোনো না কোনো প্রকারে আপোষ করতে উদ্বুদ্ধ করা যাবে বলে কোরাইশ সর্দাররা মনে করতো। এ ব্যাপারে তারা কখনো নিরাশ হয় নি। এজন্য তারা মাঝেমধ্যে তাঁর কাছে আপোষের ফর্মুলা নিয়ে হাজির হতো। তিনি তার মধ্য থেকে কোনো একটি প্রস্তাব মেনে নিলেই তাঁর ও তাদের মধ্যকার ঝগড়া মিটে যাবে বলে তারা মনে করতো। হাদীসে এ সম্পর্কে বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেছেন, কোরাইশরা রাসুলুল্লাহ (সা:)-কে বললো, আমরা আপনাকে এতোবেশী পরিমাণ ধন-সম্পদ দেবো, যার ফলে আপনি মক্কার সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে যাবেন। যে মেয়েটি আপনি পছন্দ করবেন, তার সাথে আপনার বিয়ে দিয়ে দেবো। আমরা আপনার পিছনে চলতে প্রস্তুত। আপনি শুধু আমাদের একটি কথা মেনে নেবেন- আমাদের উপাস্যদের নিন্দা করা থেকে বিরত থাকবেন। এ প্রস্তাবটি আপনার পছন্দ না হলে, আমরা আরেকটি প্রস্তাব পেশ করছি। এ প্রস্তাবে আপনার লাভ এবং আমাদেরও লাভ। রাসুলুল্লাহ (সা:) জিজ্ঞেস করলেন, সেটি কী? এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের ইবাদাত করবেন এবং আমরাও এক বছর আপনার উপাস্যদের ইবাদাত করবো।…. এরই প্রেক্ষাপটে সূরাটি নাযিল হয়। কাফিরদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়।

ধর্ম যার যার উৎসব সবার- এরকম কথা প্রকৃত মু’মীন ও মুসলিমদের মুখে মানায় না। এরকম কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা ও রাখা, আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। আমরা কারো ক্ষতি চাই না। অমুসলিমরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হোক; এটা কখনোই কাম্য হতে পারে না। তারা স্বাধীনতা নিয়ে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করুক, তাতে আপত্তি থাকতে পারে না। বিপত্তি হলো- যখন শুনি কিংবা দেখি, মুসলিম নামধারী লোকদের মাঝে যারা নিজস্ব ঈমান আক্বীদা বিসর্জন দিয়ে অজান্তেই অনৈসলামিক কাজে জড়িত হয়ে পড়েন। যা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। মুসলিম ভাই-বোনদের প্রতি অনুরোধ- আসুন, ইসলামের মৌলিক জ্ঞানার্জনে যত্নবান হই। অনুশীলনে সক্রিয় থাকি। কুরআন ও হাদীস-সুন্নাহ’র পথে অবিচল থাকার চেষ্টা করি।

[লেখক: সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরীন।]

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *