কন্যা সন্তান : সৌভাগ্যের বার্তাবাহক-মাহমুদুর রহমান দিলাওয়ার

মুক্তমত

কন্যা সন্তান সৌভাগ্যের বার্তাবাহক। কন্যা সন্তানের মা-বাবা কতই না ভাগ্যবান! যারা উপলব্ধি করতে পারেন এবং তাদের লালন করেন, তারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতেই সফলকাম হবেন; ইনশা আল্লাহ। কোনো সন্দেহ নেই। হযরত আনাস বিন মালিক রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন: যে লোক দুটি মেয়ে সন্তানকে লালান-পালন করবে, আমি এবং সে এভাবে একসাথে পাশাপাশি জান্নাতে যাবো। এই বলে তিনি নিজের হাতের দুটি আঙ্গুল একত্র করে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন। [তিরমিযী: ১৯১৪]।

হযরত আয়েশা রা: বলেন, এক মহিলা তার দুটি মেয়ে সন্তানসহ আমার কাছে এসে কিছু চাইলো। সে আমার কাছে মাত্র একটি খেজুরই পেলো। আমি তাকে তাই দিলাম। সে তা গ্রহণ করে তা দু’ভাগে ভাগ করে দু মেয়েকে দিলো। নিজে কিছুই খেলো না। তারপর সে দাঁড়িয়ে গেলো এবং বের হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর রাসুলুল্লাহ সা: আমার কাছে প্রবেশ করলে আমি তাকে ঐ মহিলা এবং তার মেয়েদের সম্পর্কে জানালাম। তখন রাসুলুল্লাহ সা: বললেন: “যে কেউ মেয়েদের নিয়ে দুঃখ কষ্টে পড়বে এবং তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে, সেগুলো তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।” [বুখারী: ১৪১৮; মুসলিম: ২৬২৯]।

রাসুলুল্লাহ সা: নিজের জীবনে কন্যা সন্তানের প্রতি কেমন ভালোবাসা থাকা উচিৎ, তার নজির স্থাপন করেছেন। ফাতেমা রা: সহ মেয়েদের সাথে তাঁর উত্তম আচরণ ও মহব্বতের বহিঃপ্রকাশ প্রেরণা যোগায়। বুখারীর বর্ণনায় পাওয়া যায়: হযরত আয়েশা রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সা: এর চলার ভঙ্গিতে চলতে চলতে ফাতেমা রা: আমাদের নিকট আগমন করলেন। তাঁকে দেখে নবী সা: বললেন, আমার স্নেহের কন্যাকে মোবারকবাদ। অতঃপর তাঁকে তার ডানপাশে অথবা বামপাশে বসালেন এবং তাঁর সঙ্গে চুপিচুপি কথা বললেন। তখন ফাতেমা রা: কেঁদে দিলেন। আমি [আয়েশা রা:] তাঁকে বললাম, কাঁদছেন কেন? নবী সা: পুনরায় চুপিচুপি তার সঙ্গে কথা বললেন। ফাতেমা রা: এবার হেসে উঠলেন। আমি [আয়েশা রা:] বললাম, আজকের মত দুঃখ ও বেদনার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ ও খুশী আমি আর কখনো দেখি নি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি সা: কী বলেছিলেন? তিনি উত্তর দিলেন, আমি আল্লাহর রাসুলের গোপন কথাকে প্রকাশ করবো না। শেষে নবী সা: এর ইন্তিকাল হয়ে যাবার পর আমি তাঁকে (আবার) জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কী বলেছিলেন? [৩৬২৩]।

তিনি বললেন, তিনি (সা:) প্রথম বার আমাকে বলেছিলেন, জিবরীল আ: প্রতি বছর একবার আমার সঙ্গে কুরআন পাঠ করতেন, এ বছর দু’বার পড়ে শুনিয়েছেন। আমার মনে হয় আমার বিদায় বেলা উপস্থিত এবং অতঃপর আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সঙ্গে মিলিত হবে। তা শুনে আমি কেঁদে দিলাম। অতঃপর বলেছিলেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, জান্নাতবাসী নারীদের অথবা মুমিন নারীদের তুমি সরদার হবে। এ কথা শুনে আমি হেসেছিলাম। [৩৬২৪]।

অথচ অনেকেই উল্টো আচরণ করেন। মেয়েদের ব্যাপারে উদাসীন। কোনো কোনো পরিবারে মেয়েদের কদর নেই বললেই চলে! ডাক্তারের পরামর্শে গর্ভবতী নারীদের নানা টেস্ট করতে হয়। তন্মধ্যে আল্ট্রাসনোগ্রাম অন্যতম। টেস্টের পর গর্ভবতী নারী কিংবা স্বজনরা গর্ভের সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে; জানতে চান। অনেক অভিজ্ঞ ও দূরদর্শী ডাক্তার এ ব্যাপারে তথ্য দিতে চান না। কেননা কন্যা সন্তানের সংবাদ পেলে কোনো কোনো পরিবারে অসন্তোষ প্রকাশ ও সুন্দর আচরণের পরিবেশ বিনষ্ট হতে দেখা যায়! যা কখনোই কাম্য হতে পারে না।

আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা: তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার মুখমন্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হয়। [১৬. সূরা আন-নাহল: ৫৮]। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন: তাকে যে সুসংবাদ দেয়া হয়, তার গ্লানির কারণে সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে। সে চিন্তা করে হীনতা সত্ত্বেও কি তাকে রেখে দেবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে তা কত নিকৃষ্ট! [১৬:৫৯]।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে আহসানুল বায়ানে বর্ণিত হয়েছে: কন্যা জন্মের সংবাদ শুনে তাদের এই অবস্থা হয়, যা বর্ণিত হয়েছে, অথচ আল্লাহর জন্য তারা কন্যা নির্ধারণ করে। তাদের সিদ্ধান্ত কতই না অসঙ্গত। অবশ্য এখানে এটা ভাবা উচিত নয় যে, মহান আল্লাহও পুত্রের তুলনায় কন্যাকে তুচ্ছ মনে করেন। না, আল্লাহর নিকট পুত্র-কন্যার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, আর না লিঙ্গ বা জাতিভেদের দিক দিয়ে তুচ্ছ বা মর্যাদাসম্পন্ন করার কোনো ব্যাপার আছে। এখানে শুধুমাত্র আরবদের একটি অন্যায় ও গর্হিত রীতিকে স্পষ্ট করাই আসল উদ্দেশ্য। যা তারা আল্লাহর ব্যাপারে পোষণ করতো; যদিও তারাও আল্লাহর সম্মান ও বড়ত্বকে স্বীকার করতো। যার যুক্তিসঙ্গত ফল এই ছিলো যে, যে জিনিস তারা নিজেদের জন্য পছন্দ করে না, সেটিকে আল্লাহর জন্যও নির্ধারণ করবে না। কিন্তু তারা তার বিপরীত করলো। এখানে শুধু এই অন্যায় আচরণকেই স্পষ্ট করা হয়েছে।

মুমিন হিসেবে আল্লাহ তায়ালা ও রাসুলুল্লাহ সা: এর নির্দেশনার আলোকেই পথ চলতে হবে। এর বিপরীত ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই। রাসুলুল্লাহ সা: কথা ও কাজে যে দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন, তা অনুসরণ করা জরুরী। জাহিলিয়াত যুগের মানুষের মতো তৎপরতা; মোটেও কাম্য নয়।

[লেখক: সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরীন।]

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *