বর্তমান দুনিয়ায় গান-বাজনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। দিনদিন এর প্রতি আসক্তি বেড়েই চলেছে। সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের নিকট সহজেই তা পৌঁছে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম গান-বাজনার ব্যাপারে অতিমাত্রায় আসক্ত। অথচ এর ক্ষতি কত ভয়ংকর, আসক্তরা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না!
গান-বাজনার ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে জাতিকে সচেতন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। গবেষণায় দেখা গেছে, গান-বাজনা মানুষের স্মৃতি-শক্তি হ্রাস করে। গান-বাজনার অনুভূতি মানুষকে সকল কিছু ভুলিয়ে দেয়। অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। উগ্রতাপূর্ণ গান-বাজনা মানুষের মাঝে উগ্রতা ছড়ায়। সিএনএন নিউজে মিউজিক নিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারী ২০১৯ সালে একটি প্রতিবেদন লেখা হয়েছে। সেখানে স্পষ্ট ভাষায় লেখা হয়েছে: গান-বাজনা বা মিউজিক নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে যে, এটি আক্রমণাত্মক চিন্তাভাবনা বা অপরাধকে উৎসাহিত করতে পারে।
গান-বাজনা মানুষকে দ্বীন-ইসলাম থেকে দূরে নিয়ে যায়। গান-বাজনা মানুষের সময় অপচয় করে। গান-বাজনা শয়তানের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, “গান হল শয়তানের ফাঁদ। সে এর মাধ্যম কম জ্ঞান, কম বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন এবং দুর্বল ঈমানের অধিকারী লোকদেরকে শিকার করে, অজ্ঞ ও ভ্রান্ত লোকদের অন্তরগুলো নষ্ট করে, মনকে কুরআন থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং পাপাচারও আল্লাহর নাফরমানিতে তাদের মনকে নিবিষ্ট করে দেয়। এটা হল, শয়তানের কুরআন এবং রহমান (দয়াময় আল্লাহ) এর মাঝে শক্ত আবরণ।” ফুযাইল ইবনে ইয়াজ (রহ.) বলেন, “গান হলো, জিনার মন্ত্র। [অর্থাৎ গান মানুষের মনের মধ্যে মন্ত্রের মত প্রভাব সৃষ্টি করে এবং জিনা-ব্যভিচারের সুপ্ত বাসনা জাগ্রত করে]।
ইসলামের দৃষ্টিতে গান-বাজনা হারাম বা নিষিদ্ধ। হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই আমার পরে এমন কিছু লোক আসবে যারা যেনা, রেশম, নেশাদার দ্রব্য ও গান-বাজনা বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে’ [বুখারী:৫৫৯০]। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘য়ালা মদ, জুয়া ও সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন’ [বায়হাক্বী, মিশকাত:৪৫০৩]। হযরত আবু ওমামা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা গায়িকা নর্তকীদের বিক্রয় করো না, তাদের ক্রয় করো না, তাদের গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র শিখিয়ে দিয়ো না, তাদের উপার্জন হারাম। [ইবনে মাজাহ, মিশকাত: ২৭৮০]।
হযরত আনাস (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.) বলেছেন, যখন আমার উম্মত নেশাদার দ্রব্য পান করবে, গায়িকাদের নিয়ে নাচ-গানে মত্ত হবে এবং বাদ্যযন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত হবে তখন অবশ্যই তিনটি ভয়াবহ বিপদ নেমে আসবে- ১. বিভিন্ন এলাকায় ভূমি ধসে যাবে ২. উপর থেকে অথবা কোন জাতির পক্ষ থেকে যুলুম অত্যাচার চাপিয়ে দেওয়া হবে ৩. অনেকের পাপের দরুণ আকার-আকৃতি বিকৃত করা হবে। আর এ গজবের মূল কারণ তিনটি। ক. মদ পান করা খ. নায়িকাদের নিয়ে নাচ-গানে মত্ত হওয়া গ. বাদ্য যন্ত্রের প্রতি আগ্রহী হওয়া।
আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা: মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞ লোকদের আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করার জন্য অসার বাক্য ক্রয় করে(১) এবং আল্লাহর প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে।(২) ওদেরই জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি (৩)। [৩১. সূরা লুকমান:৬]।
(১) সৌভাগ্যবান মানুষেরা আল্লাহর কিতাব দ্বারা পথপ্রাপ্ত হন এবং তা শ্রবণ করে উপকৃত হন। তাঁদের কথা উল্লেখের পর ঐ সকল দুর্ভাগ্যবানদের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে, যারা আল্লাহর কুরআন শ্রবণ করা থেকে দূরে থাকে, বরং গান-বাজনা ইত্যাদি খুব একাগ্রতার সাথে শোনে এবং তাতে বড় আগ্রহী হয়। এখানে ‘ক্রয় করা’র অর্থ হচ্ছে, গান-বাজনার সামগ্রী (ক্রয় করে) নিজেদের ঘরে নিয়ে আসে এবং তৃপ্তি সহকারে তার সুর ও ঝংকার উপভোগ করে। লাহওয়াল হাদীস (অসার বাক্য) বলতে গান-বাজনা ও তার সামগ্রী, বাঁশি এবং ঐ সকল যন্ত্র যা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাস করে দেয়। কেচ্ছা-কাহিনী, রূপকথা, উপকথা, নাটক, উপন্যাস, অশ্লীল ও সেক্সী পত্র-পত্রিকা এবং বর্তমানের রেডিও, অডিও, টিভি, সিডি, ভিসিয়ার, ভিসিপি, ডিভিডি এবং ভিডিও ফিল্ম ইত্যাদিও এর মধ্যে পড়ে। নবী (সাঃ)-এর যুগে অনেকে গায়িকা ক্রীতদাসী এই উদ্দেশ্যে ক্রয় করত যে, যাতে সে গান শুনিয়ে লোকেদের মন জয় করতে এবং কুরআন ও ইসলাম থেকে দূরে রাখতে পারে। এই অর্থে গায়ক-গায়িকা ও নায়ক-নায়িকাও এসে যায়। বর্তমানে যাদেরকে শিল্পী, ফিল্মী তারকা, সাংস্কৃতিক, না জানি আরো কত রকম সভ্য, চিত্তাকর্ষী এবং মন-মাতানো নামে অভিহিত করা হয়!
(২) এই সকল বস্তুর মাধ্যমে অবশ্যই মানুষ আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে যায় এবং দ্বীনকে ঠাট্টা-বিদ্রূপের নিশানা বানায়। (৩) এ সবের পৃষ্ঠপোষক ও উৎসাহদাতা সরকার, প্রতিষ্ঠান বা কারখানার মালিক, পত্র-পত্রিকার সম্পাদক, লেখক বা রচয়িতা এবং সংযোজক ও পরিচালকরাও এই কঠোর শাস্তির ভাগী হবে। (আল্লাহ আমাদের তা থেকে পরিত্রাণ দিন।) [তাফসীরে আহসানুল বায়ান]।
আলোচ্য আয়াতে লাহওয়াল হাদীস এর অর্থ ও তাফসীর সম্পর্কে ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস ও জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহুম এর মত: গান-বাদ্য করা। অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী ও তাফসীরবিদগণের মতে এর অর্থ গান, বাদ্যযন্ত্র ও অনর্থক কিসসা-কাহিনীসহ যেসব বস্তু মানুষকে আল্লাহর ইবাদত ও স্মরণ থেকে গাফেল করে, সেগুলো সবই লাহওয়াল হাদীস। ইমাম বুখারী তাঁর কিতাবে এর এ তাফসীরই অবলম্বন করেছেন। তিনি বলেন, লাহওয়াল হাদীস বলে গান ও অনুরূপ অন্যান্য বিষয় বোঝানো হয়েছে যা আল্লাহর ইবাদত থেকে গাফেল করে দেয়।
তাই গান-বাজনা থেকে দূরে থাকা এবং মানুষদের দূরে রাখা জরুরী। তরুণ প্রজন্মকে এর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে সফলতা পেতে আল্লাহ তা’য়ালার স্মরণ, আখেরাতের ভাবনা, ঈমানী ও নৈতিক মূল্যবোধ এবং দায়িত্ববোধ জাগ্রত রাখার বিকল্প নেই। পাশাপাশি সুস্থ ও মননশীল সংস্কৃতি বিকাশে প্রতিশ্রুতিশীল থাকতে হবে। জাতির কাছে ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেশ করতে হবে। এর প্রচার ও প্রসারে যথাযথ ভূমিকা পালন অনস্বীকার্য।
শেয়ার করুন